পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীর পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসহ আশপাশের খালি জায়গায় বসবে পশুর হাট। ইজারাদার চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দরপত্র আহ্বানে মাত্র দুজন অংশ নেন। তবে শিডিউল কিনেছিলেন তিনজন। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ইজারা পেয়েছেন মো. মইন উদ্দিন চিশতী। তিনি ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা ছয়বার এই হাটের ইজারা পেয়েছেন তিনি।
পোস্তগোলার মতোই ডিএসসিসির ৯টি অস্থায়ী পশুহাটের ইজারা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। শিডিউল জমা না পড়ায় দুটি হাটের ইজারা এখনো হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি হাটের ইজারা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে হচ্ছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও প্রভাব খাটিয়ে হাট দখলে নিয়েছেন সরকারি দলের প্রভাবশালীরা। অনেকে দরপত্র কিনলেও জমা দেওয়ার সাহস পাননি। তবে দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, হাট ইজারার দরপত্রে যারা অংশ নেন, তাদের কাগজপত্রে রাজনৈতিক পরিচয় লেখা থাকে না। সর্বোচ্চ দরদাতাকেই ইজারা দেওয়া হয়। প্রতি বছরই হাটের মূল্য বাড়ছে।
এদিকে, গত কয়েক বছর দেখা গেছে কিছু হাটের ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি বারবার ইজারা পাচ্ছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডিএসসিসি এলাকায় পশুর হাটের ইজারাপ্রাপ্তদের তালিকায় দেখা গেছে, লালবাগের রহমতগঞ্জ ক্লাব সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গায় পশুহাটের ইজারা পেয়েছেন মোহাম্মদ সালমান সেলিম আশিক। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাজী সেলিমের পুত্র। ঢাকা-৭ আসনের এমপি সোলায়মান সেলিম চারবার এ হাটের ইজারা পেয়েছিলেন। হাটটির সরকারি মূল্য ছিল ৫০ লাখ ২৯ হাজার টাকা। সালমান সেলিম ইজারা মূল্য দিয়েছেন ৬০ লাখ টাকা।
যাত্রাবাড়ীর দনিয়া কলেজ-সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গার জন্য এ বছর তিনটি শিডিউল বিক্রি হলেও জমা দিয়েছেন শুধু আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান। তিনি স্থানীয় কাউন্সিলর, সংসদ সদস্য আর আওয়ামী লীগ নেতাদের
সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি। হাটটির সরকারি মূল্য ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। তিনি ইজারা মূল্য দিয়েছেনে ৪ কোটি ২১ লাখ টাকা।
কদমতলী ট্রাক স্ট্যান্ড-সংলগ্ন খালি জায়গার হাটের ইজারা পেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম। হাটের সরকারি মূল্য ৬৭ লাখ ৩১ হাজার টাকার বিপরীতে ইজারা হয়েছে ৬৮ লাখ টাকায়। এ হাটে ছয়টি শিডিউল বিক্রি হলেও জমা পড়েছে তিনটি। হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকায় পশুহাটের ইজারা পাচ্ছেন মুহাম্মদ আবুল হাসনাত। তিনি হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তিনটি দরপত্র বিক্রি হলেও জমা পড়েছে দুটি। হাটটির সরকারি মূল্য ৩ কোটি ৩১ লাখ। ইজারা হয়েছে ৬ কোটি ৬ লাখ টাকায়।
ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকায় হাটের ইজারা পেয়েছেন ৪১ নম্বর ওয়ার্ড ইউনিট আওয়ামী লীগ সভাপতি আসফাক আজিম। তিনি ছাড়া আর কেউ শিডিউল ক্রয় করেননি। পুরান ঢাকার ৯ কাউন্সিলর আর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি তিনি। প্রতি বছরের মতো এবারও এই সিন্ডিকেট নির্ধারণ করে দিয়েছে কে পশুর হাটের ইজারা নেবে। ধোলাইখাল ট্রাক স্ট্যান্ডের উন্মুক্ত জায়গায় হাটের ইজারা দেওয়া হলেও এর পরিধি রায়সাহেব বাজার, দয়াগঞ্জ, মুরগিটোলা থেকে লোহারপুল এলাকাও ছাড়িয়ে যায়, যা ৯ কাউন্সিলরের এলাকার সীমানার মধ্যে পড়ে। আগে দুটি হাটের ইজারা স্থানীয় কাউন্সিলররা ভাগাভাগি করে নিতেন। এখন এই ৯ কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা একটি হাট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইজারা নেন।
হাট ইজারার সঙ্গে আছেন স্থানীয় ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর ছেলে ইমতিয়াজ মন্নাফী, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রোকন উদ্দিন আহমেদ, ৪০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম আজাদ, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি সারোয়ার হোসেন, ৪২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফ হোসেন ছোটন, ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান, ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামসুজ্জোহা, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদউল্লাহ মিনু এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। হাটটি ইজারার সরকারি দর ছিল ৩ কোটি ৯১ লাখ, ইজারা হয়েছে ৪ কোটি ৩ লাখ টাকায়।
৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান বলেন, গত বছর আমি পশুর হাটের মধ্যে ছিলাম না। কিন্তু এ বছর ৯ কাউন্সিলর আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা মিলে হাট নিয়েছেন। ইজারাদার আমাদের ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সারোয়ার হোসেন আলোর বন্ধু।
আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গায় হাটের ইজারা পেয়েছেন এস এম নেওয়াজ সোহাগ। তিনিও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত। সোহাগ ছাড়া আরেকজন দরপত্র কিনলেও জমা দেননি। মেরাদিয়া বাজার-সংলগ্ন খালি জায়গার ইজারা পেয়েছেন খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আবু সাঈদ। হাটটির সরকারি মূল্য ২ কোটি ৩৬ লাখ। ইজারা হয়েছে ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকায়। এই হাটের ইজারা নিতে চারজন দরপত্র কিনলেও জমা দিয়েছেন দুজন।
উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘ ক্লাব সংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের ইজারা পেয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর হামিদুল হক। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। এই হাটটি সাত বছর ধরে শাহজাহানপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল লতিফ ইজারা নেন। কিন্তু এ বছর তিনি হজে যাবেন বলে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে সাবেক কাউন্সিলরের নামে হাটের ইজারা নেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দরপত্রে অংশ নেন আব্দুল লতিফ। তবে এই হাটটি বরাবরের মতো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে নিশ্চিত করেছেন আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, হজে যাওয়ার কারণে এ বছর হাটটি নিজের নামে নেওয়া হয়নি।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ডিএসসিসি ১১টি কোরবানির পশুর হাটের ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয় গত ৪ এপ্রিল। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার প্রথম পর্যায়ের দর আহ্বান হয়েছিল। এতে ৯টি হাটের ইজারার উন্মুক্ত দরপত্র করা হয়। বাকি দুটি হাটের মধ্যে লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাব-সংলগ্ন খালি জায়গাসহ কমলাপুর স্টেডিয়াম-সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গায় কেউ কোনো শিডিউল কেনেননি। তবে এ হাটটি বরাবরের মতো ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম ভাট্টি নিয়ন্ত্রণ করেন। গত বছরও প্রথম পর্যায়ে এই হাট ইজারা নিতে কেউ দরপত্র কেনেননি। আর আফতাবনগর খালি জায়গায় দুটি শিডিউল বিক্রি হলেও কেউ জমা দেননি। আগামী ১৩ ও ২৮ মে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ের দরপত্র আহ্বান করা হবে।
কোরবানি পশুর হাট বরাবরের মতো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে কি না—এমন প্রশ্নে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী কালবেলাকে বলেন, ‘দরপত্র আবেদন প্রক্রিয়া উন্মুক্ত করে দিয়েছি। শিডিউল বিক্রি হয়েছে সংখ্যায় বেশি। তবে সবাই দরপত্র জমা দেননি। এটি প্রথম পর্যায়। আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখবে। প্রয়োজনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়েও দরপত্র নেওয়া হবে।’